চেনা
-শুভায়ন বসু
যদিও পশ্চাদ্দেশের ফোঁড়াটা জ্বালাচ্ছে দু’দিন ধরেই, তবুও সকালে ঘুম থেকে উঠেও পড়েছিলুম ঠিকঠাক ।তারপর চশমাটি নিঃশব্দে চোখে নিয়ে বাসি মুখেই মোবাইলে খুটখুট করছিলুমও যথারীতি। হঠাৎই গিন্নির তাগাদা দিয়ে দিনটা শুরু হয়ে গেল, একেবারে রসকষহীনভাবেই দুম করে শুরু হয়ে গেল।
কিন্তু এই সাধারন দিনটা যে একটা অসাধারণ দিন হিসেবে পরিগণিত হবে তা কে জানত? আজ অফিস ছুটি, বাজারটাও সেরে ফেলেছিলুম এক্কেবারে সেন্ট পার্সেন্ট বিনা ভুলে। চুনোমাছ কিনিনি, মাছের পিস ছোট করে কাটাইনি, গিন্নির ঢেঁড়স অবশ্যই কিনেছি এবং আমার প্রিয় বরবটি মাত্র আড়াইশো গ্রামের বেশি কিনিনি (বেশি বেশি বরবটি কিনি বলে আমার কিঞ্চিত বদনাম আছে), দুধের প্যাকেট নিতেও যথারীতি ভুলতে ভুলতেও ভুলিনি এবং ছেঁড়াফাটা নোট বা একগাদা খুচরো পয়সারও আমদানি করিনি। ফুলকপিটা পেয়েছিলুম জলের দরে আর বেগুনগুলোর চেহারা ছিল একেবারে ঘি চকচকে। শাকের বান্ডিলও বেছে বেছে কিনেছিলুম,পচা টচা ছিল না। যাকগে, দুর্দশার কাহিনী বলতে এসেছি, বাজারের কিস্যা নয়।
তো সেসব সেরে বাড়িতে পৌঁছতেই, পুনর্বার নির্মম অর্ডার হল। ছেলের আজ পরীক্ষা, স্কুল থেকে নিয়ে আসতে হবে, পুলকার আসবে না। যাই হোক যথারীতি বিস্বাদ, একঘেয়ে জলযোগ, (যা নিয়ে কোন অভাব অভিযোগ জানানো মানা, আর করলেও তা ভস্মে ঘি ঢালার মত) গলধঃকরণ করে অগত্যা বেরিয়ে পড়তে হল পুরনো সেকেন্ডহ্যান্ড গাড়িটা নিয়ে। জানলার কাঁচ ছিল নামানো, মৃদুমন্দ হাওয়াও আসছিল, স্টিরিওতে গান চালাতে গিয়ে দেখলুম স্পিকারটা কেটে গেছে, সেই শুরু। ঘ্যাংকোর ঘ্যাংকোর শব্দে কান ঝালাপালা।তাড়াতাড়ি সেটা বন্ধ করে নিজেই বেসুরো গুনগুন গান করতে শুরু করেছিলুম মহানন্দে। যদিও তখনো জানিনা কি দিনটাই না অপেক্ষা করে আছে আমার জন্য, যদি জানতুম!
কিছুদূর যাবার পরই গাড়িটা টানতে শুরু করলো একদিকে, যেন চলতেই চায়না। স্কুল তখন অল্পই দূর, প্রায় দেখা যায়। গাড়িটা রাস্তায় সাইড করে, নেমে দেখি, সর্ব্বনাশ! সামনের চাকা বসে গেছে। নির্ঘাত পাংচার। এই অবস্থায় আর চালালে সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা, টিউব বদলানোর মতো পয়সা নেই। এখনো মাসের চার পাঁচ দিন পড়ে আছে, কোনোক্রমে চালিয়ে নিতে হবে ফাটা রেকর্ডের বেজে যাওয়া একটানা গানের মত। এখন চাকাটাকে কোনোক্রমে খুলে স্টেপনিটা লাগিয়ে নিলেই কেল্লাফতে। বাকি পরে দেখা যাবে। এই মনে করে ডিকি থেকে জ্যাকটা বের করলুম। জ্যাকটার অবস্থা শীর্ণ, মরচে ধরা।ক্যাচোরকোঁচোর শব্দে সেটা ভীষণ আপত্তি জানাতে লাগল। কতদিন ব্যবহার হয়নি, কে জানে? আমার আশঙ্কাকে নির্ভুল প্রমাণ করে সে সত্যিই দেহ রাখল। বেঁকে তেবড়ে তার দেহ পড়ে রইল। পাশে কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি। আমার দুরবস্থা দেখে এগিয়ে এল একটা কমবয়সী ছেলে, কোন পুলকারের চালক। রাস্তার ওপাশে তার গাড়ি দাঁড় করিয়ে সে বোধহয় ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছিল। ছেলেটি নেমে এসে বলল ‘কি দাদা,পাংচার?’ বললুম ‘হ্যাঁ ভাই, জ্যাকটাও গেছে।’ বললাম না শুধু টায়ার নয়,প্রেস্টিজটাও পাংচার। হাতে কালি মেখে, ভ্যাবলা ক্যাবলার মত মাঝরাস্তায় দাড়িয়ে আছি, ঠিক যেন একটা জোকার। তখনই গিন্নির ফোন এল। ছেলের স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, পৌঁছেছি কিনা। বলতে গেলুম ‘গাড়ি খারাপ হয়েছে,’ কিন্তু তার আগেই পিঁ পিঁ করে মোবাইলটা সুইচড অফ হয়ে গেল। যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়। এবার মোবাইলটাও দেহ রাখল। আরো একটা ধাক্কা খেলাম। ক’দিন ধরেই চার্জারটা লুজ কানেকশন হচ্ছিল, সারারাত চার্জই হয়নি, মনে হচ্ছে। চার্জার আর মোবাইলের বাপান্ত করতে লাগলুম। এদিকে ছেলের স্কুল ছুটি হয়ে গেছে, আর আমি রাস্তায় ত্রিশঙ্কু। মুখ কাঁচুমাচু করে ছেলেটিকে বললুম ‘ভাই, কি হবে এখন?’ আমার বিপন্ন, বিপর্যস্ত দশা দেখে তার দয়া হল। সে আশ্বাস দিয়ে বলল ‘দাঁড়ান,দেখছি।’ বলে, তার গাড়ির ডিকি থেকে একটা নতুন জ্যাক নামিয়ে নিয়ে এল। ‘সরুন, আমি করে দিচ্ছি’ বলে নিপুণ হাতে, চটপট চাকাটা খুলে ফেলল। বুঝতেই পারলাম সে ড্রাইভার কাম মেকানিক। বিপদের মধ্যে যেন আশার আলো দেখতে পেলুম। পাংচার চাকাটা খুলে ছেলেটি বলল ‘কই, আপনার স্টেপনি দিন এবার, লাগাতে হবে।’ মহানন্দে ডিকি থেকে অব্যবহৃত স্টেপনি বার করে দিলুম। সে তো স্টেপনি মাটিতে নামিয়েই আর্তনাদ করে উঠল। ‘এ কি করেছেন? স্টেপনিতে তো হাওয়াই নেই!’ তার আর্তনাদের সঙ্গে সঙ্গে আমার বুকটাও যেন হায় হায় করে উঠল। এবারে স্টেপনিও গেল, কি হবে? একে একে সবাই সুযোগ বুঝে আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে লাগল। বৃথা শাপ-শাপান্ত, গালমন্দ। আমি যেন নির্বাক, অপদার্থ একটা কাঠপুতুল, মুখটা হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলুম। এরপর কি বলতে হবে, আমার জানা নেই। ছেলেটি মোটেও ঘাবড়াল না, আমাকে দাবড়ালও না। এই বিপদে আমাকে ছেড়েও গেল না। বলল ‘স্টেপনিতে হাওয়া ভরে রাখেন না?’ আমার মনে পড়ল গাড়িতে যখনই হাওয়া ভরি, খুবই আলিস্যি করে ড্রাইভার সিট থেকে নেমে ডিকিটা আর খুলি না। চারটে চাকায় হাওয়া ভরা হয়ে গেলেই, তাচ্ছিল্যভরে একটা দশ টাকার নোট গরিব ছেলেটার ময়লা হাতে আলগোছে দিয়েই, সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে, নিজেকে দুনিয়ায় রাজা প্রতিপন্ন করে চলে যাই, প্রতিবারই। স্টেপনির কথা মনেই থাকে না। সেই তাচ্ছিল্যের আজ সে বদলা নিল, একেবারে মোক্ষম সময়ে। ঘাম মুছে বোকার মত জানতে চাই ‘তাহলে কি হবে?’ এবারও সে আমার রক্ষাকর্তা হয়ে হাজির হয়, আমার মত অপোগন্ডকে সে এবারেও ক্ষমা করে দেয়, আর আমি সেই একমাত্র আশাভরসা, একমাত্র শেষ অবলম্বনকে জড়িয়ে ধরি। ‘দাঁড়ান, দিন আমাকে চাকাটা। আমি গাড়িতে করে সামনের মোড় থেকে সারিয়ে নিয়ে আসছি। আপনি যাবেন আমার সাথে?’ আমি দেখলাম আমার হয়ে ছেলেটা যখন এতই করছে, এত সময় নষ্ট করছে, তার মানে এর বোধহয় কোন কাজই নেই। স্বার্থপরের মত তাই বললাম ‘ভাই, তুমি করিয়ে আনোনা একটু, আমি টাকা দিয়ে দিচ্ছি।’ যেন টাকা দিলেই দুনিয়ার সমস্ত বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়, যেকোনো পরিস্থিতিতে টাকাই যেন শেষ কথা। আমার সেই ঔদ্ধত্য সে তার সরল মনে বুঝতে পারল না। হাত পেতে বলল ‘দিন টাকা’। আমি স্যাট্ করে পেছনের পকেটে থেকে মানিব্যাগ বের করে টাকা দিতে গিয়ে প্রথম বার থাপ্পড়টা খেলুম। মানিব্যাগে মাত্র তিরিশটা খুচরো টাকা পড়ে আছে, সব টাকা বাজারে শেষ। সাবেক মধ্যবিত্ত আমি, বাজারে মানিব্যাগ খালি হয়, এ আর নতুন কি? পুঁজিও এমন নেই যে, সেই মানিব্যাগ পরমুহূর্তেই নতুন টাকায় ভরে দেব। বুরবক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। এবার মনে হয়, আমি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলব। এত অপমানিত জীবনে হইনি। লজ্জায় মাথা কাটা যেতে লাগল। এবারেও পরিত্রাতা হয়ে ছেলেটি বলল ‘ও টাকা নেই, ঠিক আছে। আমি আমার নামে লিখিয়ে করে আনছি। আপনি নাম বলে, কাল দিয়ে দেবেন দোকানে। ঠিক আছে?’ আমি পুতুলের মত ঘাড় নাড়ি। সে চাকা নিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে যায়। পরক্ষণেই মনে হয় নামটাই জানা হয়নি ছেলেটার, ঠিক আছে ফিরুক, তখন জেনে নেব। আবার কিঞ্চিৎ সন্দেহও হয়, চাকাটা নিয়ে হাপিস হয়ে যাবে না তো? আজকাল তো কত কিছুই হচ্ছে! চারিদিকে এ.টি.এম. ফ্রড আর লোকঠকানো ব্যবসা।কাকে বিশ্বাস করব? আসলে মানুষ চিনি না আমিও, এই পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সেও। কে সৎ আর কে অসৎ কে জানে? মানুষকে বিশ্বাস করতে ভয় হয়। পরক্ষণেই চোখ পড়ে যায় ছেলেটার জ্যাকটার ওপর, আমার গাড়িতেই লাগানো আছে, নতুন ।একটা পাংচার হওয়া শতচ্ছিন্ন চাকার থেকে কম দাম হবে না নিশ্চয়ই। আরো একটা যেন থাপ্পর এসে পড়ে গালে। মানুষকে অবিশ্বাস করার শাস্তি। মানুষ না চিনে ,অমানুষকে আপন করে নেবার প্রায়শ্চিত্ত কবে যে করব, কে জানে? খেয়াল হল, ছেলের অনেকক্ষণ ছুটি হয়ে গেছে। এটুকু রাস্তা হেঁটে গিয়ে বরং নিয়ে আসি স্কুল থেকে। অগত্যা পদব্রজন, ঘামতে ঘামতেই। ছেলেকে অনেক জবাবদিহি করে, অবশেষে ফিরতে শুরু করি। মনে মনে ভাবি এর চেয়ে শতগুণ বেশি জবাবদিহি এখনও অপেক্ষা করে আছে বাড়িতে, শতগুণ অপমান। নিজের অপদার্থতার এবারে সবকিছু খুল্লামখুল্লা হল বলে। মনটা ভারাক্রান্ত হয়, হাজার বেগড়বাঁই এই একই দিনে হতে হলো? কি কুক্ষণেই না আজকের ছুটিটা আরাম আয়েশ করে কাটিয়ে দেব ভেবেছিলুম! সে কি আর হবার জো আছে? কার যে মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিলুম আজ! মনে পড়তেই ঢোঁক গিলে নিলুম, এ কথা ভুলেও বলা যাবে না। নিজেই জোর করে ভুলে নিলুম,গিলে নিলুম সেকথা।এখন বাড়িতে পৌঁছতে পারলে হয় ।এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে গাড়ির শবদেহের পাশে এসে উপস্থিত হলুম। ঠক ঠকাঠক শব্দে ততক্ষণে কাজ শুরু হয়ে গেছে, চাকা সারিয়ে এনে ফিটিং হচ্ছে। পাঁচ মিনিটেই কাজ শেষ। সব কাজ সেরে, ডিকি বন্ধ করে, হাত তাত মুছে, ছেলেটি হেসে সামনে এসে বলল ‘যান, হয়ে গেছে।’ ছেলেটির হাত দু’টো ধরে, অজস্র ধন্যবাদ দিয়ে বললাম ‘ভাই, তোমার নামটা তো জানা হয়নি। টাকা দেবার সময় বলতে হবে কাল।’ ‘কোন কিছু দিতে হবে না, আমার চেনা দোকান। ক’টাকাই বা খরচ হয়েছে।’ ‘তবু তোমার নামটা?’ ‘শেখ জামাল’, বলে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিল সে। হাত নেড়ে চলে যেতে যেতে বলল ‘স্টেপনিতে হাওয়া দিয়ে রাখবেন এবার।’ তার গাড়ি আমার হতভম্ব চোখের সামনে দিয়ে হুশ্ করে চলে গেল। মনে হল জামাল নাম না হয়ে. অন্য কোন নাম শুনলেই যেন বেশি খুশি হতাম। সেটাই সেদিন আমার গালে শেষ থাপ্পর হয়ে নামল, আগের চেয়েও জোরে। মানুষ চিনিনা আমি, দেশটাকেও চিনিনি কিছুই। নিতান্তই একটা গোমুখ্যু হয়ে এতগুলো বছর পার করে দিলুম।
গাড়ি স্টার্ট দিলুম। ভাবছিলুম, আজকের দিনটা খারাপ না ভাল? এতগুলো খারাপ অভিজ্ঞতাকে ম্লান করে দিল একটা ভাল অভিজ্ঞতা। মনটা ভাল হয়ে যায়, শেষমেষ সারাদিনের সব গ্লানি ধুয়ে যায় জামালের মতো একটি ছেলের সান্নিধ্য, তার পরম মনুষ্যত্ব, অচেনা অজানা একটি বিপদগ্রস্ত মানুষকে অবলীলায়, সব কাজ ছেড়ে সাহায্য করার মহত্বের কাছে। আসলে এটাই আমার দেশ। একদিনেই আমি সারা জীবনের শিক্ষা পাই, সেটাই আমার পরম পাওয়া হয়।বাকি রাস্তা ছেলেকে সেটাই বোঝাতে বোঝাতে আসি, কে জানে বোঝে কিনা? আজ না বুঝলেও, আমার মতোই একদিন বুঝবে ঠিকই, নিশ্চিন্ত হই।
খুবই ভালো
ধন্যবাদ